পৃথিবীর সব উন্নত ভাষার মতো বাংলা ভাষারও একাধিক আলাদা রূপ আছে : একটি বলার ভাষা বা মৌখিক রূপ, অপরটি লেখার ভাষা বা লৈখিক রূপ। ভাষার মৌখিক রূপের আবার দুটো রীতি রয়েছে, যথা : আঞ্চলিক রীতি ও প্রমিত রীতি। অপর দিকে লৈখিক রূপেরও দুটো আলাদা রীতি আছে, যেমন : চলিত রীতি ও সাধু রীতি ।
বাংলা ভাষার এ প্রকার বা রীতি-ভেদ নিচে ছকের সাহায্যে দেখানো হলো :
আঞ্চলিক ভাষারীতি : বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বাঙালি জনগোষ্ঠী মুখে মুখে যে ভাষারীতিতে মনোভাব ব্যক্ত করে সে ভাষারীতিই বাংলার ‘আঞ্চলিক ভাষারীতি' নামে অভিহিত। অর্থাৎ অঞ্চলভেদে বাংলা ভাষার প্রচলিত কথ্যরূপকেই আঞ্চলিক ভাষারীতি বলে।
যেমন— বাংলাদেশের চট্টগ্রাম অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষারীতি: ‘ঔগোয়া মাইনষ্যের দুয়া পোয়া আছিল। ' অর্থাৎ একজন লোকের দুটি ছেলে ছিল। আঞ্চলিক ভাষাকে উপভাষা বলে। আঞ্চলিক ভাষায় শব্দের বহুবিচিত্র রূপ দেখা যায়। যেমন: ‘ছেলে' শব্দটি অঞ্চলভেদে ছোয়াল, ছাওয়াল, ছাবাল, ছেইলে, পোলা, পোয়া, পুয়া, ব্যাটা, ব্যাডা, পুত, হুত ইত্যাদি উচ্চারিত হয়।
প্রমিত ভাষারীতি : বিভিন্ন ভাষারীতি কালক্রমে পরিমার্জিত হয়ে সবার গ্রহণযোগ্য একটি রূপ লাভ করে। এই ভাষারীতি সাধারণত শিক্ষিত লোকের কথাবার্তা ও নিত্য ব্যবহারে আরও আকর্ষণীয় হয়। ভাষাও যে শ্রমসাধ্য, প্রযত্নলব্ধ এবং শেখার কোনো বিষয়— প্রমিত ভাষারীতি তার প্রমাণ। এক কথায়, ভাষার সর্বজনগ্রাহ্য ও সমকালের সর্বোচ্চ মার্জিত রূপকেই প্রমিত ভাষারীতি বলে৷ যেমন: ‘একজনের দুটো ছেলে ছিল। ’
সাধু ভাষারীতি : যে ভাষারীতি অধিকতর গাম্ভীর্যপূর্ণ, তৎসম শব্দবহুল, ক্রিয়াপদের রূপ প্রাচীনরীতি অনুসারী এবং আঞ্চলিকতামুক্ত তা-ই সাধু ভাষারীতি। যেমন: ‘এক ব্যক্তির দুইটি পুত্র ছিল। ' এই রীতি শুধু লিখিত গদ্যে পরিদৃষ্ট হয়।
চলিত ভাষারীতি : ভাগীরথী নদীর তীরবর্তী স্থানসমূহের মৌখিক ভাষারীতি মানুষের মুখে মুখে রূপান্তর লাভ করে প্রাদেশিক শব্দাবলি গ্রহণ এবং চমৎকার বাভঙ্গির সহযোগে গড়ে ওঠে। এই ভাষারীতিকেই চলিত ভাষারীতি বলে। এই রীতি মৌখিক ও লিখিত উভয় ক্ষেত্রেই আকর্ষণীয় ও আদরণীয়। যেমন: ‘একজন লোকের দুটি ছেলে ছিল। ’
সাধু ভাষারীতির বৈশিষ্ট্য
ক. সাধু ভাষার রূপ অপরিবর্তনীয়। অঞ্চলভেদে বা কালক্রমে এর কোনো পরিবর্তন হয় না।
খ. এ ভাষারীতি ব্যাকরণের সুনির্ধারিত নিয়ম অনুসরণ করে চলে। এর পদবিন্যাস সুনিয়ন্ত্রিত ও সুনির্দিষ্ট।
গ. সাধু ভাষারীতিতে তৎসম বা সংস্কৃত শব্দের ব্যবহার বেশি বলে এ ভাষায় এক প্রকার আভিজাত্য ও গাম্ভীর্য আছে।
ঘ. সাধু ভাষারীতি শুধু লেখায় ব্যবহার হয়। তাই কথাবার্তা, বক্তৃতা, ভাষণ ইত্যাদির উপযোগী নয়।
ঙ. সাধু ভাষারীতিতে সর্বনাম ও ক্রিয়াপদের পূর্ণরূপ ব্যবহৃত হয়।
চলিত ভাষারীতির বৈশিষ্ট্য
ক. চলিত ভাষা সর্বজনগ্রাহ্য মার্জিত ও গতিশীল ভাষা। তাই এটি মানুষের কথাবার্তা ও লেখার ভাষা হিসেবে গৃহীত হয়েছে। এটি পরিবর্তনশীল।
খ. এ ভাষারীতি ব্যাকরণের প্রাচীন নিয়মকানুন দিয়ে সর্বদা ব্যাখ্যা করা যায় না।
গ. চলিত ভাষারীতিতে অপেক্ষাকৃত সহজ-সরল শব্দের ব্যবহার বেশি বলে এটি বেশ সাবলীল, চটুল ও জীবন্ত। ঘ. বলার ও লেখার ভাষা বলেই এ ভাষা বক্তৃতা, ভাষণ, নাটকের সংলাপ ও সামাজিক আলাপ-আলোচনার জন্য অত্যন্ত উপযোগী।
ঙ . চলিত ভাষারীতিতে সর্বনাম ও ক্রিয়াপদের সংক্ষিপ্তরূপ ব্যবহৃত হয়।
সাধু ও চলিত ভাষারীতির মধ্যে নানাদিক থেকে বেশ কিছু পার্থক্যও রয়েছে। এ দুই ভাষারীতির বৈশিষ্ট্য থেকেই তার ধারণা পাওয়া যায়। নিচে সাধু ও চলিত ভাষারীতির কয়েকটি পার্থক্য দেখানো হলো :
সাধু ভাষারীতি | চলিত ভাষারীতি |
১. সাধু ভাষারীতি সর্বজনগ্রাহ্য লেখার ভাষা। | ১. চলিত ভাষারীতি সর্বজনবোধ্য মুখের ও লেখার ভাষা। |
২. সাধু ভাষারীতি সব সময় ব্যাকরণের নিয়ম মেনে চলে। | ২. চলিত ভাষা সব সময় ব্যাকরণের নিয়ম মেনে চলে না। |
৩. সাধু ভাষায় পদবিন্যাস রীতি সুনির্দিষ্ট। | ৩. চলিত ভাষায় পদবিন্যাস রীতি অনেক সময় পরিবর্তিত হয় ৷ |
৪. সাধু ভাষায় তৎসম বা সংস্কৃত শব্দের ব্যবহার বেশি। | ৪. চলিত ভাষায় তৎসম বা সংস্কৃত শব্দের ব্যবহার কম। |
৫. সাধু ভাষা বক্তৃতা, ভাষণ ও নাটকের সংলাপের উপযোগী নয়৷ | ৫. চলিত ভাষা বক্তৃতা, ভাষণ ও নাটকের সংলাপের উপযোগী৷ |
৬. সাধু ভাষায় সর্বনাম, ক্রিয়া ও অব্যয় পদের পূর্ণরূপ ব্যবহৃত হয়৷ | ৬. চলিত ভাষায় সর্বনাম, ক্রিয়া ও অব্যয়পদের সংক্ষিপ্তরূপ ব্যবহৃত হয়। |
৭. সাধু ভাষা গুরুগম্ভীর, দুর্বোধ্য ও মন্থর। | ৭. চলিত ভাষা চটুল, সরল ও সাবলীল। |
৮. সাধু ভাষারীতি অপরিবর্তনীয়, তাই কৃত্রিম। | ৮. চলিত ভাষারীতি পরিবর্তনশীল, তাই জীবন্ত |
নিচের কয়েকটি ক্ষেত্রে সাধু ও চলিত ভাষারীতির পার্থক্য দেখা যায়। যথা :
১. বিশেষ্যপদের রূপে
২. সর্বনামপদের রূপে
৩. ক্রিয়াপদের রূপে
8. অব্যয়পদের রূপে
সাধু | চলিত |
---|---|
অগ্নি | আগুন |
কর্ণ | কান |
চন্দ্র | চাঁদ |
দন্ত | দাত |
পক্ষী | পাখি |
ব্যার্ঘ্র | বাঘ |
মৎস | মাছ |
হস্তী | হাতি |
সাধু | চলিত |
---|---|
এই | এ |
ইহা | এ |
ইহাকে | একে |
ইহাদের | এদের |
উহা | ও |
উহাদিগের | ওদের |
কাহাকে | কাকে |
কেহ | কেউ |
তাহা | তা |
তাহার | তার |
যাহা | যা |
যাহাদের | যাদের |
সাধু | চলিত |
---|---|
আসিয়া | এসে |
করিয়া | করে |
করিয়াছে | করেছে |
খাইতেছিল | খাচ্ছিল |
গিয়াছিল | গেছিল |
ঘূমাইতেছে | ঘুমাচ্ছে |
চলিল | চলল |
চাহিয়া | চেয়ে |
জ্বালাইয়া | জ্বেলে |
ডাকিতেছে | ডাকছে |
নিদ্রা যাওয়া | ঘুমানো |
পড়িব | পড়ব |
পার হইয়া | পেরিয়ে |
ফুটিয়া উঠেছে | ফুটে উঠেছে |
বলিয়াছিলেন | বলেছিলেন |
বলিয়া | বলে |
বলিতে থাকিবে | বলতে থাকবে |
বলতে থাকবে | ভেঙে যেতে লাগল |
লম্ফ প্রদান করিল | লাফ দিল |
শুনিল | শুনল |
শুনিয়াছিল | শুনেছিল |
শয়ন করিলেন | শুলেন |
শ্রবণ করিলাম | শুনলাম |
সাধু | চলিত |
---|---|
অদ্য | আজ |
অদ্যাপি | আজও |
কদাচ | কখনো |
তথাপি | তবুও |
নচেৎ | নইলে |
নতুবা | নইলে |
প্রায়শ | প্রায়ই |
যদ্যপি | যদিও |
সাধু ভাষারীতি
“উপন্যাসের অনুরূপ কোনো বস্তু আমাদের প্রাচীন সাহিত্যে খুঁজিয়া পাওয়া যায় না। শুধু আমাদের দেশ বলিয়া নহে, পৃথিবীর কোনো দেশেরই পুরাতন সাহিত্যে উপন্যাসের দর্শন মিলে না। উপন্যাসের প্রধান বিশেষত্বই এই যে, ইহা সম্পূর্ণ আধুনিক সামগ্রী। ”
চলিত ভাষারীতি
“একে একে গাড়িগুলো ছেড়ে দিল, আমার গাড়িটাও চলতে শুরু করল । স্টেশন দূরে নয়, সেখানে পৌঁছে নামতে গিয়ে দেখি অতিথি দাঁড়িয়ে। কিরে, এখানেও এসেছিস? সে লেজ নেড়ে তার জবাব দিল, কী জানি মানে তার কী!”
আরও দেখুন...